পোস্টগুলি

আমাদের ব্যর্থ রাষ্ট্র

এইটা একটা বিখ্যাত ছবি হতে যাচ্ছে। কারন প্রতিদিনতো আকাশ থেকে টুপ করে বিমান পড়ে স্কুলের বাচ্চা মারা যায় না! তাই এইরকম ধবংসস্তুপ দেখতে পাওয়াটা দূর্লভ।

সোমবার ২১শে জুলাই, বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষন বিমান ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের উপর গিয়ে পড়ে। হতাহতের সংখ্যা কেউ সঠিক বলছে না। তবে গোনা যাবে একসময়। কারন স্কুলের বাচ্চাদের পরিবার আছে, হাজিরার সিস্টেম আছে।

আমি সারাদিন অনেক কিছু লেখার চেষ্টা করেও লিখতে পারিনি। কোন কাজও করতে পারিনি গত দুইদিন। মানুষের সীমাহীন অভিযোগ আর একে অপরের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা দেখছিলাম সোশ্যাল মিডিয়ায়। নিহত বৈমানিককে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শায়িত করা হয়েছে। মৃত বাচ্চাদের যাদের দেহ পাওয়া গিয়েছে পরিবারের লোকজন নিজের মত করে সৎকার করেছেন। রাষ্ট্র চুপ হয়ে আছে। অসভ্য রাষ্ট্র, আ ফেইল্ড স্টেইট।

পৃথিবীর যেকোন উন্নত রাষ্ট্র সর্বোচ্চ চেষ্টা করে তার বাচ্চাদের বাচানোর জন্য। তাদের জন্য আলাদা স্কুল বাস, সেটা অতিক্রম করলে কঠিন জরিমানার ব্যবস্থা থাকে। স্কুলের আশেপাশে অনেক জায়গা জুড়ে নিরাপত্তা বলয়, মাইনর হিসেবে তাকে সর্বোচ্চ সুবিধা দেয়া, যাতে ঠিকমত পড়াশোনা করতে পারে সেজন্য যা যা করা দরকার, ইত্যাদি হাজার রকম বিষয় নিয়ে তারা কাজ করে।

যদি সেখানে এরকম ট্র্যাজেডি হত তবে এতক্ষনে তাদের সরকার নড়েচড়ে বসত অথবা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পদত্যাগ করত। ভাগ্যিস আমাদের কোন সরকার নেই। আমাদের আছে শিক্ষার নামে ব্যবসা আর দেশপ্রেমের নামে ইতরামি। 

আমরা আমাদের বাচ্চাদের শিখিয়েছি রাস্তায় আন্দোলন আর নেতা হতে হলে কি করতে হয় সেটা। We have failed our children. 

একটা জাতি ধর্মের নামে নোংরামি করে, জাতীয়বাদের চেতনায় দূর্নীতি করে, কেউ বিপদে পড়লে তামাশা দেখে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে সারা পৃথিবীর থেকে পিছিয়ে, নূন্যতম সিভিক সেন্স নাই - এইখানে এর থেকে বড় দূর্যোগ আসলে ব্লাডি সিভিলিয়ান হাজারে হাজারে মরবে।

আঙ্গুল তুলে ভুল দেখিয়ে দেবার হাজারটা জায়গা আছে। আজকে কিছুই করতে চাচ্ছি না। খুব ক্লান্ত লাগছে। গত জুলাই থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কেউ মরছে।

রাষ্ট্র বলে আলাদা কিছুর অস্তিত্ব নেই। যেখানে একদল মানুষের চিন্তার প্রতিফলন ঘটে সেটাই রাষ্ট্র। আমাদের চিন্তা অস্বচ্ছ, অসৎ, লোভাতুর আর ধার্মিক। 

দূর্ঘটনা ঘটতেই পারে, কিন্তু সেটা ঘটার উপকরণ যদি রাষ্ট্র ছড়িয়ে রাখে তবে সেই রাষ্ট্র একটা বাতিল চিন্তা-ভাবনা নিয়ে এগুচ্ছে। বাংলাদেশ একটা মৃত্যুপুরী, এইখানে বেঁচে থাকাটাই একটা যুদ্ধের মত। এটাই প্রথম বা শেষ নয়, সামনে আরো দূর্যোগ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। সবকিছু একটা চেইন রি-অ্যাকশনের মত  কাজ করে।

 

অ-সুখ বিলাস

প্রায় তিনবছর পর তিনদিন জ্বরে ভুগলাম। আমি ধারনা করেছি চিকেন গুনিয়া। 

সাধারনত আমি জ্বর, ঠান্ডা, সর্দি-কাশি এইগুলোতে ভুগি না। ছোটবেলায় এতবার অসুস্থ হয়েছি যে আমার ধারনা আমার বডিতে ইতিমধ্যে হাজার হাজার এন্টিবডি তৈরি হয়ে বসে আছে। নতুন করে ভাইরাস ঢুকতে গেলেই বলে - এই ব্যাটা তোকে তো চিনি। তুই আবার এসেছিস?

অসুস্থতা এবার কিছুটা উপভোগ করেছি। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এই তিনদিনের বেশিরভাগ  সময়ই আমি ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। কারন আমাদের শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা সবচেয়ে ভালো কাজ করে যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি। রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, প্রোটিন তৈরি করে আক্রান্ত স্থানের জন্য নতুন কোষ তৈরি, সেল রিপেয়ার ইত্যাদি নানা কাজে সে তখন মনযোগ দিতে পারে। ঘুম তাই উত্তম চিকিৎসা।

চিকেন গুনিয়ার নামে কেন "চিকেন" আছে এটা আমি জানি না। তবে মারাত্বক বিরক্তিকর একটা জ্বর। সারা শরীরের জয়েন্ট এ ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। মানুষের আদি পুরুষের মত এই ভাইরাসও (CHIKV) আফ্রিকা থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে।

ক্লায়েন্টের নতুন কোন কাজ ছিলনা। নিজের লেখালেখি থেকেও ছুটি। সেই সাথে বাইরে তুমুল বৃষ্টি আর জ্বরের ঘোরে একটা নেশাতুর অবস্থা, সব মিলিয়ে সোনায় সোহাগা যাকে বলে।  

"আমি সহজে অসুস্থ হই না" - এই কথাটা যতবার আমি বলি, আমার আশেপাশের বন্ধুবান্ধব খুব বিরক্ত হয়। তারা মনে করে আমি নিজেকে সুপারম্যান দাবি করছি। ব্যাপারটা আসলে সেরকম না। জীবন যাপনে আমি কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চলি। আমি বিশ্বাস করি আমাদের বেশিরভাগ সমস্যা খাবার থেকেই শুরু হয়। আমি খুব পরিমিত আহার করি। বাধ্য না হলে আমি বাইরের খাবার খেতে চাই না। বুদ্ধি হবার পর থেকে রাস্তায় বানানো খাবার খাই না।

আমি চিনি খাই না। মিষ্টি জাতীয় যেকোন জিনিস থেকে আমি দশহাত দূরে থাকার চেষ্টা করি। ফ্রিজে কোন খাবার দুই দিনের বেশি থাকলে আমি আর সেটা খাই না। বাসার ফ্রিজে যদি কেউ খোলা পাত্রে খাবার রাখে, আমি সেটাও ফেলে দেই। ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাসের অভাব নাই আমাদের ফ্রিজে। এরা খুব আরামে থাকে ফ্রিজের তাপমাত্রায়। সেখানে খোলা পাত্রে খাবার রাখাটা একধরনের অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

এখন খেতে হলে আমি এখনই রান্না করার লোক। রান্না করে পরে খাবো এই চিন্তাটা আমাকে পীড়া দেয়। 

আমি আসলে অসুস্থ হতে চাই না। কয়দিন আগেই মাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াদোড়ি করতে হয়েছে সপ্তাহখানেক। হাসপাতালে আমাকে প্রতিমাসে অন্যদের জন্য এতবার যেতে হয় যে আমার হাসপাতাল ভীতি ধরে গেছে একরকমের। আমি জানি আমি অসুস্থ হলে আসলে আমাকে সেবা করার কেউ নেই। আমার কাজগুলো করার কেউ নেই। আমার খাবার বানিয়ে দেবার কেউ নেই, আমার আবদার রক্ষা করার লোক নেই।

বড় হবার একটা ভীষণ যন্ত্রনা আছে। আপনি স্বাধীনতা পাবেন কিন্তু সেটা অন্যেরা কেড়ে নেবে। আপনার সময় কেড়ে নেবে ভালোবাসার নামে। উপার্জিত অর্থ কেড়ে নেবে দায়িত্বের নামে। আমি তাই অসুস্থ হতে চাই না, কারন আমাকে দেখে রাখার কেউ নাই।

মৃদু জ্বর, মাথা ব্যাথা, সর্দি কাশি, পেট ব্যাথা, মন খারাপ ইত্যাদি তাই আমার কখনো হয় না। আমি সহজে অসুস্থ হইনা। অসুস্থ হবার মত বিলাসিতা আমার নেই। 

 

 

আমার একলা সময়

হুমায়ুন আজাদ এর একটা অসম্ভব সুন্দর কবিতা আছে। 

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো
ছোট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যে
একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
দোয়েলের শিসের জন্যে
শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো চোখের মণিতে
গেঁথে থাকা একবিন্দু অশ্রুর জন্যে
একফোঁটা রৌদ্রের জন্যে

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
এক কণা জ্যোৎস্নার জন্যে
এক টুকরো মেঘের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো টাওয়ারের একুশ তলায়
হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে
এক ফোঁটা সবুজের জন্যে

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে
খুব ছোট দুঃখের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো ঘুমের ভেতরে
একটি ছোটো দীর্ঘশ্বাসের জন্যে
একফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে। 

পুরোটা জুড়েই তিনি মৃত্যুর কথা বলে গেছেন। অথচ বোঝাতে চেয়েছেন বেঁচে থাকার জন্য আমাদের কত কত  সুন্দর কারন রয়েছে। একদল মানুষ ক্ষমতার লোভ, অর্থের অহংকার অর্জনের জন্য বেঁচে থাকে। অথচ আমাদের বেঁচে থাকাটাই এক বিস্ময়। 

ফুলের পাপড়ির উপর জমে থাকা একটা শিশিরবিন্দু দেখেও মন আপ্লুত হতে পারে। আকাশের মেঘ দেখে মন চাইতে পারে আরেকটু বেঁচে থাকি এই বর্ষার কদম দেখার জন্য।

আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আমার মৃত্যুটা কেমন হবে! 

খুব সম্ভবত আত্মীয় পরিজন, পরিচিত মানুষ, চেনা মুখের বন্ধু ছাড়া নির্জন শীতল কোন ঘরে। যদিও খুব করে চাই মৃত্যুর আগে আমাকে ঘিরে থাকুক পরিচিত পরিবেশ আর প্রিয় কোন মুখ।

মৃত্যুকে রোমান্টিসাইজ করতে চাই না। একলা থাকতেও আমার ভয় নেই। তবু কোথাও যেন একটা অভিমান লুকিয়ে থাকে।

যা কিছু আছে বিলিয়ে যাই
আমার সময় নাই, সময় নাই
দেখা হয়নি, বলা হয়নি যা ছিল গোপন
একটা মানুষও পেলামনা আপন

জীবনটা খুব সুন্দর, অনেকদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এত অল্প সময়ে কত কিছুই দেখা হয়না করা হয়না। শুধু সময় নষ্ট করে যাই। 

অতিরিক্ত তথ্যের যুগ

মানুষের জন্মের ইতিহাস কত বছরের?

একদম সঠিকভাবে বলা না গেলেও আমরা জানি আধুনিক মানুষ প্রায় ৩ লাখ বছর আগে আফ্রিকায় তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। এই মানুষেরা Homo heidelbergensis বা একই ধরণের একটা প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হয়েছিল। এরপর তারা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের বাকি যত প্রজাতি ছিল তাদের প্রতিস্থাপন করে।

এই তথ্য অনেকেই জানেন না। জানার আসলে দরকারও নেই। আপনার ব্যক্তিগত জীবন যাপনে এই তথ্য কোন কাজে আসবে না।

আমরা বাস করছি এমন একটা সময়ে যখন অতীত সব মানুষের থেকে আমরা সবচেয়ে বেশি জানি। বেশি জানি বলাটা মনে হয় ভুল। আমরা অতীতের মানুষের থেকে বেশি তথ্য ভান্ডারের সাথে যুক্ত আছি। 

পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা জায়গায়। ইন্টারনেট নামক ইনফরমেশন হাইওয়েতে যুক্ত হওয়াতে আমরা এখন এই তাবৎ জ্ঞান হাতের মুঠোফোনেই বা কম্পিউটার স্ক্রিনে পেয়ে যাচ্ছি নিমিষে।

চিন্তা করে দেখুন প্রতিদিন কি পরিমানে বেদরকারি তথ্য আপনি হজম করছেন। সব যে কাজে লাগছে বা মনে রাখতে পারছেন তা কিন্তু নয়। এর কিছু আপনার মনে থাকছে আর কিছু অযথাই আপনি পড়ছেন বা দেখছেন সময় নষ্ট করে।

মিলিয়নের মত বই, পডকাস্ট, ভিডিও, গান, গল্প হাতের মুঠোয় থাকায় কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরবেন সেটা ঠিক করতে পারছেন না। অস্থির হয়ে পড়ছে মানসিকতা। এই যে একটা প্রজন্ম Information Overload এর মধ্যে পড়ে গেছে, এরা সত্যিকার অর্থে কিছু শিখছে না বা করছে না। 

অতিরিক্ত তথ্য প্রবাহের কারনে মানুষ আজকে মনোযোগ দিতে পারছে না সাধারণ কাজেও। মাল্টি টাস্কিং নামক একটা যন্ত্রনা নিজেদের জীবনে ঢুকিয়ে নেয়ায় কোন কাজেই তারা সফল হতে পারছে না। মানুষের মস্তিষ্ক একসাথে দুটো কাজে মনোযোগ দেয়ার জন্য তৈরি হয়নি। অতিরিক্ত এই তথ্যের যুগে সবাই মাল্টি টাস্কিং করতে গিয়ে গোলমাল পাকিয়ে ফেলছে ব্যাক্তিগত জীবনেও।

আপনি পড়ছেন বা লিখছেন আর একই সাথে গান শুনছেন, এই ধরনের কাজ করলে কোনটাই ঠিকমত হবে না। মোবাইলে স্ক্রীন খুললেই সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনীতি, রান্না, বিনোদন, ধর্ম, শিক্ষা ইত্যাদি সকল কিছুর একটা জগা খিচুড়ি মার্কা তথ্যের ফিড ভেসে আসছে।

ক্ষতিটা কি হল?

সময় নষ্ট হল, কিছু শিখলেন না। এই সময়ে নিজের যে কাজ করতেন সেটাও হল না। অনেক তথ্য হজম করতে গিয়ে মস্তিষ্ক কোনটাই ঠিকমত নিতে পারল না। নিজের কাজের দরকারি তথ্য বাদেই বেহুদা রাজনীতির প্যাচাল ঢুকে গেল মাথায়। অথচ জীবনে কোনদিন আপনি রাজনীতি করবেন না।

সোশ্যাল মিডিয়া থেকে তাই মাঝে মধ্যে দূরে থাকুন। অহেতুক নিজের মতামত দেয়া থেকে বিরত থাকুন। কারো পোস্টের কমেন্ট সেকশনে গিয়ে তাকে ভুল প্রমান করার কোন দরকার নেই। পারলে দিনের কয়েক ঘন্টা মোবাইল থেকে দূরে থাকুন।

হাজার হাজার বই পড়ারও আপনার দরকার নেই। পৃথিবীর সবকিছু জানতে হবে এমন দিব্যিও কেউ আপনাকে দেয়নি। অযথাই নিজের জীবনকে ব্যস্ত আর জটিল করে তুলবেন না।

আইনস্টাইন অনেক বড় বিজ্ঞানী ছিলেন। পৃথিবী বদলে দেয়া আবিষ্কার আছে তার। তারপরেও তিনি ভ্রমন করেছেন, বেহালা বাজাতেন, সাইকেল চালাতেন। যতটা পেরেছেন জীবনকে উপভোগ করেছেন। আপনি তার থেকে জ্ঞানী নন। 

জীবন উপভোগ করতে শিখুন। তার আগে শিখুন কিভাবে এই অতিরিক্ত তথ্যের যুগে নিজেকে নিরাপদ রাখবেন। 

 

২০২৫ এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যর্থতা

গণতন্ত্র গড়ে ওঠে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। যেখানে জনগন সরকার এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের উপর ভরসা রাখে, দেশের আইন আর বিচারে বিশ্বাস রাখে।

স্বৈরতন্ত্র গড়ে ওঠে ভয়ের উপর। জনগণ সারাক্ষন ভয়ে থাকে, এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ে। একজন ব্যক্তি বা একটি দলই তখন সবধরনের সুযোগ সুবিধা পায়। তারা যা বলে দেশের আইন তাই করে। দরকারে তারা সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে।

স্বৈরতন্ত্রের পতন সাধারনত বিপ্লবের মাধ্যমে হয়। এরপর যদি দেশে শান্তি ফিরে না আসে এবং  জনগণের আস্থা আর বিশ্বাস আবার প্রতিষ্ঠা না করা যায়, দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো স্বরূপে ফেরত না আসে তবে অবধারিতভাবে আরেকটি বিপ্লবের ভিত প্রস্তুত  হয়ে যায়।

বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে হাসিনা রেজিমের পতনের পর দেশে শান্তি ফিরে আসেনি। প্রতিষ্ঠানগুলো আগের থেকে খারাপ অবস্থায় চলে গেছে। কার্যত কোন ধরনের পুলিশ ব্যবস্থা নেই, অথবা নতুন বিপ্লবীরা পুলিশকে ডিক্টেট করার চেষ্টা করছে। অগনিত মিথ্যা মামলা আর মব ভায়োলেন্স চলছে। তৌহিদি জনতা নামক একটা উদ্ভট শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে। যাদের কাজ হচ্ছে ধর্মের নামে নানা ধরনের সহিংস অপরাধ জায়েজ করা। নারীদের নিরাপত্তা প্রশ্নাতীতভাবে কমেছে নতুন বাংলাদেশে।

যাদের চাকরি চলে গেছে তারা বলতে পারবে দেশ এগিয়েছে না পিছিয়েছে। সংস্কারের নামে যা চলছে তা কোনভাবেই কাম্য নয়। দৃশ্যত ইউনুস সরকার ফেইল করেছে গনতান্ত্রিকভাবে সমস্যার সমাধান করতে। তাই তারা এখন ভয় প্রতিষ্ঠার কাজ করছে। 

মোস্তফা সরোয়ার ফারুকি -যিনি সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা তাকে অপ্রিয় প্রশ্ন করায় সাংবাদিকের চাকুরি চলে গেছে। প্রফেসর ইউনুসকে নিয়ে কোন সমালোচনা করলেই বিচারের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এরকমটা হচ্ছে কেন?

১৯৭১ কে মুছে দিয়ে কোন বাংলাদেশ থাকতে পারে না। আওয়ামীলীগের একচেটিয়া মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক ব্যবসাকে মুছে দিতে গিয়ে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস আর মুক্তিযুদ্ধকে কলংকিত করাটাও এই সরকারের আমলেই হয়েছে। মোটাদাগে বলা চলে Yunus you have failed. 

যখন জনগন বুঝতে পারবে আপনি তৃতীয় কোন শক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছেন, অথবা কোন ধরনের সংস্কার করতে পারেননি, তখন স্বাভাবিক ভাবেই আপনার জনপ্রিয়তা কমে যাবে। ক্ষমতার লোভে আপনি এবং আপনারা গদি আকঁড়ে ধরে থাকতে চাইলে আবার একটা স্বৈরাচারী সরকারের জন্ম দেবেন।

সবাই ভুলে যায় - No One Is Indispensable in a Democracy. There is always an alternative when it comes to politics.

দেশ চরম একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় আছে এবং যেকোন সময় মৌলবাদের চরম উত্থান ঘটতে পারে। এদের নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হবে। স্বাভাবিক ভাবেই নতুন বিপ্লবের পথে হাঁটবে বাংলাদেশ। আর যেখানে ক্রমাগত বিপ্লব হয় সেখানে না থাকে শান্তি না থাকে প্রগতি। 

 

দাওয়াত

দাওয়াত ব্যপারটাকে আমি এড়িয়ে চলি। দাওয়াত একটা চেইন রিএকশনের মত। কারো বাসায় দাওয়াতে গেলে ভদ্রতা করে আপনাকেও তাদের দাওয়াত দিতে হবে। তার মানে শুধু একদিন সময় নষ্ট হবে না, আরেকদিন সময় নষ্ট করার জন্য আপনাকে তৈরি থাকতে হবে। 

বাঙালী সামজিকতা বেশিরভাগ সময়েই আমার ভাল লাগে না। এরা একসাথে হলেই নানা অনর্থক বিষয় নিয়ে বেহুদা ক্যাচাল করে। পারিবারিক দাওয়াতে না যাওয়ার আরেকটা প্রধান কারন হল, খাবার ভালো না হলেও মিথ্যে করে বলতে হয় খাবার মজা হয়েছে।

আমি যেখানে থাকি সেখানে বিরিয়ানি আর পোলাও এত ভাল পরিমানে পাওয়া যায় যে, কেউ আমাকে তার বাসায় নিয়ে এই দুটো খাইয়ে খুশি করতে পারবে না। তাই শুধু খাবার জন্য কোথাও যাওয়াটা আমার কাছে সময় নষ্ট মনে হয়। 

আর বাকি থাকল আড্ডা দেয়া। দাওয়াতে গেলে যদি এমন কেউ না থাকে যার সাথে আড্ডা দিয়ে মজা পাওয়া যায়, তবে মনে হয় ইচ্ছে করে কেউ একজন আপনাকে শাস্তি দিচ্ছে। একদল বেকুব লোকের সাথে কয়েক ঘন্টা একটা বদ্ধ জায়গায় কাটানো একটা বড় ধরনের শাস্তি।

কোন একটা দাওয়াতে গেছি, কারো সাথে কিছু একটা আলোচনা করতে গেছি, দেখলাম আমার সব কথাতেই তিনি হ্যাঁ বলছেন, সম্মতিসূচক মাথা নাড়ছেন। বুঝলাম ভদ্রলোক আসলে আমার কথা মন দিয়ে শুনছেন না। আমার বক্তব্যের কোন পালটা যুক্তিও দিতে চাচ্ছেন না। এই ধরনের লোক পরে গিয়ে আমাকে বাচাল আর জ্ঞানপাপী বলবে।

আরেকদল লোক থাকে যারা অনবরত আপনার প্রশংসা করে যাবে। এরাও খুব বিরক্তিকর। প্রশংসা ভালো লাগে কিন্তু আমি নারসিসিস্ট নই যে অনবরত আমার কাজের প্রশংসা করে যেতে হবে। আমি যখন কারো সাথে সময় কাটাতে চাই, আমি এমন কাউকে খুঁজি যে যুক্তি দিয়ে আমার কথা খন্ডন করতে পারবে। তবেই একটা আলোচনা জমে।

আমাকে অসামাজিক বললেও আমার কিছু যায় আসে না। কারন আমার বেশিরভাগ বিপদের দিনেই আমি কোন ধরনের সাহায্য পাইনি এদের কাছ থেকে। না মানসিক, না আর্থিক কোনভাবেই। তাই এই অহেতুক সময়ক্ষেপন আমার করতে ভাল লাগে না।

একটা বয়সের পর আমি বুঝতে শিখেছি, কাউকে খুশি করার থেকে নিজেকে খুশি রাখাটা বেশি দরকার। লোকে কি বলবে এই ধারনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। পৃথিবীতে যে অল্প সময় থাকব সেখানে আরেকজনকে বা সমাজকে খুশি করার আমার কোন দরকার নেই। আমি রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নেতা নই। আমাকে ভণিতা করে চলতে হবে না। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।

 

মোবাইলঃ অদৃশ্য শেকলের উত্থান

আমি যখন ছোট ছিলাম তখন মোবাইল ছিল না। আমি জানতাম টেলিফোনে দূরের মানুষের সাথে কথা বলা যায়। সেই টেলিফোন তার দিয়ে অনেক দূরের আরেকটা টেলিফোনের সাথে সংযোগ করা থাকে। এক্সচেঞ্জ হাউজের অস্তিত্ব তখন আমার কাছে ছিল না।

কলেজ ভর্তির পর প্রথম মোবাইল পাই। তাও সিমেন্সের একটা এনালগ সেট। সেখানে আজকের মত স্মার্ট দুনিয়ার হাতছানি ছিল না। এই প্রযুক্তি আমার কাছে সবসময়েই ফিউচারিস্টিক মনে হয়েছে। কখন যে সেই শুধু কথা বলার যন্ত্র বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠল সেটা বুঝতে পারিনি। 

এরপর একদিন দেখলাম তারে বাঁধা টেলিফোন মোবাইলে রুপান্তরিত হয়ে গেছে আর মানুষগুলো কি এক অদৃশ্য তারে বাঁধা পড়ে গেছে। এখন যেখানেই যায় মোবাইল সাথে নিয়ে যায়। এমনকি টয়লেটে গেলেও হাতে মোবাইল থাকে। ইশ্বরের উপসনা গৃহে গেলেও এই অদৃশ্য তার তার লেজের সাথে বাঁধা থাকে।

সব থেকে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে মোবাইল আসার পর চাইলেই যে কাউকে যে কোন সময় বিরক্ত করা যায়। দিন নেই রাত নেই মোবাইল বাজলেই আমরা আঁতকে উঠি। চট করে ফোন ধরার চেষ্টা করি। দূরে থাকলে দৌড়ে গিয়ে ফোন রিসিভ করার চেষ্টা করি।

সময় মত  আবার একে চার্জ দিতে হয়, টাকা খাওয়াতে হয়। কে কত দামি ফোন ব্যবহার করে সেটার একটা প্রতিযোগিতা আছে সবার মাঝে। কাছে থাকার চেষ্টায় সবাই একটা অদৃশ্য শেকলে বাঁধা পড়ে গেছে।

আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মোবাইল নামক এই প্রযুক্তিকে আমরা নিয়ন্ত্রন করছি না, বরঞ্চ এই যন্ত্র আমাদের নিয়ন্ত্রন কর্তা হয়ে গেছে।

আমি নিজে একজন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা লোক। তারপরেও মোবাইল নামক যন্ত্রটার কিছু জিনিস আমি মেনে নিতে পারিনা। এই যে যখন তখন যাকে তাকে ফোন দেয়া যায়। 

আমি নিজের জন্য কিছু নিয়ম তৈরি করেছি। খুব বেশি দরকার না হলে আমি মোবাইল হাতে রাখি না। কেউ ফোন দিলেই আমি ধরি না। আমি আমার ইচ্ছামত ফোন ধরি। চাইলেই আমার সাথে কথা বলা যাবে এই ধারনা থেকে আমার পরিচিত জনদের বেরিয়ে আসতে হবে। কথা বলতে চাইলে আগে থেকে টেক্সট করে জানাতে হবে।

এমনিতেও মানুষের সাথে আমার খুব বেশি কথা বলতে ভাল লাগে না। মোবাইলেতো আরো লাগে না। এর দুটো কারন আছে। মোবাইলে কথা বলার সময় মানুষের চোখ আর মুখ দেখা যায় না। অথচ ভাবের আদান প্রদানের জন্য এই দুটো বিষয় আবশ্যক বলে আমি মনে করি।

দ্বিতীয়ত, মোবাইলে অনায়াসে মিথ্যে বলে দেয়া যায়। শুয়ে থাকলে বলা যায় কাজ করছি, নিউমার্কেট থাকলে বলা যায় চিটাগং আছি। অপরপক্ষ জানতেই পারে না আপনি যন্ত্রের সহায়তায় মিথ্যে বলছেন।

আমাদের কি এমন হবার কথা ছিল?

প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রনে থাকার কথা ছিল, আমরা প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রনে কেন চলে গেলাম? 

চাইলেই মোবাইল নামক যন্ত্রটাকে জীবন থেকে বাদ দিতে পারব না। তবে একে নিয়ন্ত্রন করা খুব সম্ভব। অপ্রয়োজনে মোবাইল হাতে নেবেন না, অযথা কাউকে ফোন করবেন না। অপরিচিত হলে ফোন করার আগে টেক্সট করে সময় চেয়ে নিন।

মোবাইল নামক যন্ত্রের দাসত্ব বাদ দিন। পকেটে একটা কম্পিউটার থাকাটা প্রযুক্তির একটা বিস্ময়, আনন্দের বিষয়। কিন্তু  তার প্রেমে পড়ে যাওয়াটা মানুষ হিসেবে অকিঞ্চিৎকর, অপমানজনক।