মোবাইলঃ অদৃশ্য শেকলের উত্থান
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন মোবাইল ছিল না। আমি জানতাম টেলিফোনে দূরের মানুষের সাথে কথা বলা যায়। সেই টেলিফোন তার দিয়ে অনেক দূরের আরেকটা টেলিফোনের সাথে সংযোগ করা থাকে। এক্সচেঞ্জ হাউজের অস্তিত্ব তখন আমার কাছে ছিল না।
কলেজ ভর্তির পর প্রথম মোবাইল পাই। তাও সিমেন্সের একটা এনালগ সেট। সেখানে আজকের মত স্মার্ট দুনিয়ার হাতছানি ছিল না। এই প্রযুক্তি আমার কাছে সবসময়েই ফিউচারিস্টিক মনে হয়েছে। কখন যে সেই শুধু কথা বলার যন্ত্র বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠল সেটা বুঝতে পারিনি।
এরপর একদিন দেখলাম তারে বাঁধা টেলিফোন মোবাইলে রুপান্তরিত হয়ে গেছে আর মানুষগুলো কি এক অদৃশ্য তারে বাঁধা পড়ে গেছে। এখন যেখানেই যায় মোবাইল সাথে নিয়ে যায়। এমনকি টয়লেটে গেলেও হাতে মোবাইল থাকে। ইশ্বরের উপসনা গৃহে গেলেও এই অদৃশ্য তার তার লেজের সাথে বাঁধা থাকে।
সব থেকে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে মোবাইল আসার পর চাইলেই যে কাউকে যে কোন সময় বিরক্ত করা যায়। দিন নেই রাত নেই মোবাইল বাজলেই আমরা আঁতকে উঠি। চট করে ফোন ধরার চেষ্টা করি। দূরে থাকলে দৌড়ে গিয়ে ফোন রিসিভ করার চেষ্টা করি।
সময় মত আবার একে চার্জ দিতে হয়, টাকা খাওয়াতে হয়। কে কত দামি ফোন ব্যবহার করে সেটার একটা প্রতিযোগিতা আছে সবার মাঝে। কাছে থাকার চেষ্টায় সবাই একটা অদৃশ্য শেকলে বাঁধা পড়ে গেছে।
আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মোবাইল নামক এই প্রযুক্তিকে আমরা নিয়ন্ত্রন করছি না, বরঞ্চ এই যন্ত্র আমাদের নিয়ন্ত্রন কর্তা হয়ে গেছে।
আমি নিজে একজন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা লোক। তারপরেও মোবাইল নামক যন্ত্রটার কিছু জিনিস আমি মেনে নিতে পারিনা। এই যে যখন তখন যাকে তাকে ফোন দেয়া যায়।
আমি নিজের জন্য কিছু নিয়ম তৈরি করেছি। খুব বেশি দরকার না হলে আমি মোবাইল হাতে রাখি না। কেউ ফোন দিলেই আমি ধরি না। আমি আমার ইচ্ছামত ফোন ধরি। চাইলেই আমার সাথে কথা বলা যাবে এই ধারনা থেকে আমার পরিচিত জনদের বেরিয়ে আসতে হবে। কথা বলতে চাইলে আগে থেকে টেক্সট করে জানাতে হবে।
এমনিতেও মানুষের সাথে আমার খুব বেশি কথা বলতে ভাল লাগে না। মোবাইলেতো আরো লাগে না। এর দুটো কারন আছে। মোবাইলে কথা বলার সময় মানুষের চোখ আর মুখ দেখা যায় না। অথচ ভাবের আদান প্রদানের জন্য এই দুটো বিষয় আবশ্যক বলে আমি মনে করি।
দ্বিতীয়ত, মোবাইলে অনায়াসে মিথ্যে বলে দেয়া যায়। শুয়ে থাকলে বলা যায় কাজ করছি, নিউমার্কেট থাকলে বলা যায় চিটাগং আছি। অপরপক্ষ জানতেই পারে না আপনি যন্ত্রের সহায়তায় মিথ্যে বলছেন।
আমাদের কি এমন হবার কথা ছিল?
প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রনে থাকার কথা ছিল, আমরা প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রনে কেন চলে গেলাম?
চাইলেই মোবাইল নামক যন্ত্রটাকে জীবন থেকে বাদ দিতে পারব না। তবে একে নিয়ন্ত্রন করা খুব সম্ভব। অপ্রয়োজনে মোবাইল হাতে নেবেন না, অযথা কাউকে ফোন করবেন না। অপরিচিত হলে ফোন করার আগে টেক্সট করে সময় চেয়ে নিন।
মোবাইল নামক যন্ত্রের দাসত্ব বাদ দিন। পকেটে একটা কম্পিউটার থাকাটা প্রযুক্তির একটা বিস্ময়, আনন্দের বিষয়। কিন্তু তার প্রেমে পড়ে যাওয়াটা মানুষ হিসেবে অকিঞ্চিৎকর, অপমানজনক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন