ব্যক্তিগত তথ্য

লেখালেখি করে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করা বাদে আমি খুব নিভৃতে থাকা মানুষ। আমি লোকজনের সাথে খুব একটা মিশতে চাইনা। যতবারই সোশ্যালাইজিং করার চেষ্টা করেছি, মানুষের অহংকার আর ভয়ংকর রকমের নির্বুদ্ধিতার পরিচয় তাদের সাথে মিশতে আমাকে বাধা দিয়েছে।

আমি ধনী-গরীব, উঁচু সরকারি বা রাজনৈতিক পদ, সামাজিক স্ট্যাটাস দেখে আড্ডা দেই না। শুধু নির্বোধের সাথে আড্ডা দিতে আমার আপত্তি আছে।

বাচ্চার স্কুলের সামনে এক ভদ্রলোক সেদিন আমাকে হটাত করে বললেন আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে। আমি নির্লিপ্তভাবে বললাম, এখানেই দেখেছেন। বাচ্চাকে নিতে আসি, দিতে আসি। 

এরপর তিনি জানতে চাইলেন, আপনি থাকেন কোথায়? এই ভদ্রলোকের সাথে আজকেই আমার প্রথম দেখা। আমার স্মৃতিশক্তি এতই খারাপ নয় যে তাকে আগে দেখে থাকলে ভুলে যাবো।

আমি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললাম, ভাই এত কিছু জানার কি দরকার? এরপর আপনি, জানতে চাইবেন, আমি কি করি, আমার বাচ্চাকাচ্চা কয়জন, বউ কি করে, কয় ভাই-বোন আমরা... কি দরকার এত অপ্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে। 

তার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। আমি গ্রাহ্য করলাম না। একটা বয়সের পর মানুষ আর শেখে না। কিছুটা অপমান করে যদি এদের মাথায় ঢোকানো যায় অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোটো ভদ্রতার পরিচয় নয়।

পাশেই আমার এক বন্ধুর মেয়ে ছিলো। তাকে শুনিয়ে শুনিয়েই আমি বললাম, শোনো মা, তুমি এখন থেকেই শেখো, কেউ বিনা কারনে প্রশ্ন করে তোমার ব্যক্তিগত তথ্য জানতে চাইলে তাকে সরাসরি না বলবে। আর কাউকে নিজের গায়ে হাত দিয়ে আদর করতে দেবে না। সে তোমার বাবার যত কাছের বন্ধুই হোক।

মানুষ তার স্বভাবেই অন্যের ব্যাপারে কৌতূহলী। কিন্তু একজন ব্যাস্ত মানুষ সেই কৌতূহল নিবৃত্ত করে তার নিজের কাজে মনোযোগ দেন। আরেকজনের জীবনে কি ঘটছে সেটা নিয়ে গালগল্প করার মানে আপনার নিজের জীবনে কোন ধরনের আনন্দ নেই, উত্তেজনা নেই। সেটার ঘাটতি কাটাতে আপনার অন্যের বিষয়ে ছোঁকছোক করতে হয়।

আগে আমার ধারনা ছিল এই কাজটা শুধু মেয়েরাই করে। এখন দেখলাম ছেলে মানুষেরও এই স্বভাব আছে। অদ্ভুতভাবে এরকম স্বভাবের যাদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে তাদের সবাই ধার্মিক লেবাস পরে ছিলেন।

আমরা বাঙ্গালীরা বুঝতেই চাইনা নিজের তথ্য সহজে কাউকে দিতে হয় না। আপনার বাসার ঠিকানা, এনআইডি নম্বর, পাসপোর্টের তথ্য, ব্যাংকিং ইনফরমেশন, পরিবারের সদস্যদের ছবি, ইত্যাদি সবই খুব সেনসিটিভ তথ্য বহন করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এগুলোর যথেচ্ছা ব্যবহার ঝামেলা বাদে ভালো কিছু ডেকে আনে না।

এখনতো অনেকে তাদের বেডরুমের খবর পর্যন্ত ভ্লগিং এর নামে অনলাইনে ছড়াচ্ছেন। স্বস্তা জনপ্রিয়তার লোভে বিক্রি করার চেষ্টা করছেন নিজের প্রাইভেসির শেষ অংশটুকু।

আমি পারতপক্ষে কাউকে আমার ফোন নম্বরও দিতে চাই না। অহেতুক মোবাইলে কথা বলাটা আমার কাছে একটা বিরক্তিকর বিষয়।

রেষ্টুরেন্টে খেতে গেলে বা দোকানে কিছু কিনতে গেলে মেম্বারশিপের নামে এরা নম্বর চায়। আমি দেই না। দিলেও এমন একটা নম্বর দেই যেটা আমি ব্যবহার করি না। আমার কোন দরকার নেই সারাদিন তাদের প্রমোশনাল মেসেজ আর ফোন কল রিসিভ করার।

এরপরও নানা কারনে আমাকে অনেক নির্বোধের কাছে নিজের তথ্য দিতে হয়েছে। যেটা আমার খুবই অপছন্দের ছিল এবং আমি জানি এগুলোর বাজে ব্যবহার হবে। যথাসম্ভব এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছি পারিনি। নির্বোধের কাছে নিজের গোপনীয় তথ্য দামি না হতে পারে কিন্তু আমি চেষ্টা করেও এই ব্যপারে নির্বোধ হতে পারছি না।

বাসায় বুয়া/হোম মেইড রাখার যে "বাঙালি" সংস্কৃতি সেটাও আমার পছন্দের না। আমি এখনও নিজের রান্না নিজে করতে পারি, অনালাইনে অর্ডার করতে পারি সময় না থাকলে। প্রযুক্তির সহায়তা থাকায় কাপড় ধোয়ার কাজেও সময় নষ্ট করতে হয়না। যেহেতু চব্বিশ ঘন্টার বিশ ঘন্টা আমি বাসায় থাকতে পারি, অন্যদের মত রাস্তার জ্যাম আর মানুষ ঠেলে, ধুলোবালি খেয়ে আমাকে অফিস করতে হয় না, তাই যথেষ্ট সময় থাকে নিজের কাজ নিজে করার।

বুয়া কালচার আমার অপছন্দ কারন এদের লাই দিলেই মাথায় ওঠে এবং ভাল ব্যবহার করলে তার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। সবচেয়ে বড় কথা এদের প্রবেশ আমার শোবার ঘর পর্যন্ত, খুব কাছের মানুষ না হলে যেখানে আমি কাউকে প্রবেশের অনুমতি দেই না এবং এরা এক বাসার খবর আরেক বাসায় গিয়ে বলে, যেটা আমার খুবই অপছন্দের। 

যেই কাজ আমি নিজে করতে পারি সেটা অন্যকে দিয়ে করানোর আমি কোন মানে দেখি না। সবচেয়ে বড় কথা যেহেতু আমি বাসায় বসে কাজ করি, কাজের লোক বাসায় আসা মানে আমার দিনের একঘন্টা সময় নষ্ট হওয়া এবং লেখালেখিতে একটা অহেতুক বিরতি পড়া। এই বিরতি আমার বিশ্রাম এবং লেখার কাজে বাধ সাধে। এর থেকে নিজে কিছু কায়িক শ্রম করাটা আমার কাছে উত্তম মনে হয়।

যাদের আমরা উন্নত বিশ্ব বলি, যাদের দেশের ভিসা পেলে বাঙ্গালীর স্বর্গসুখ অনুভব হয় সেখানে কিন্তু সবাই নিজের কাজ নিজেই করে। নিজের গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে, বাজার নিজে করে, বাগান পরিষ্কার করে, স্কুল বাস না থাকলে বাচ্চাকে নিজে স্কুলে নিয়ে যায় - বলা চলে তার একার পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব সে তাই করে। আমি কোন ভাবেই মনে করিনা আমরা বাঙ্গালীরা তাদের থেকে খুব একটা ভালো জীবন-যাপন করি। 

এদের মধ্যে যারা বেশি সচেতন তারা আরো দুটো জিনিস করে, নিয়মিত শরীরচর্চা করে আর প্রচুর বই পড়ে। দিনশেষে এই দুটো জিনিসই আপনার নিজের কাছে থাকে

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন