হাসপাতালে ঈশ্বর অনুপস্থিত থাকেন, প্রার্থনায় থাকে মানুষ
জীবনের একটা ব্যাস্ত সময় পার করেছি। হাসপাতাল আর বাসা করতে করতেই সারাদিন শেষ। এইদিকে ক্লায়েন্টের প্রোগ্রাম্যাটিক সমস্যা সমাধানের তাড়া অন্যদিকে আরেকজনের জীবন-মৃত্যু ছুয়ে ফিরে আসা। গত দশ বছরে আমাকে যে পরিমান হাসপাতালে দোড়াদৌড়ি করতে হয়েছে এই পরিমান শ্রম আর সময় নিয়ম করে আমি অন্যকিছুতে দেইনি।
কয়দিন আগে আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে নিয়ে গেলাম ধানমন্ডি ইবনে সিনা হাসপাতালে। ইমার্জেন্সি থেকে একটা কেবিনে শিফট করতেই সারাদিন পার। এরপর শুরু হল টেস্টের ধাক্কা। প্রায় দু'লাখ টাকার লম্বা একটা বিল নিয়ে হাসপাতাল থেকে তাকে সুস্থ করে আনলাম।
এরা বিল পেইড করার আগে হাসপাতাল থেকে রোগী বের হতে দেয় না। কেউই দেয় না। কাস্টমার একবার চলে গেলে যদি বিল না দেয়া হয়! হাসপাতাল থেকে রিলিজের দিন শুক্রবার ছিল। আমার মা অস্থির ছিল বাসায় ফেরার জন্য, আর তাদের তখন জুম্মার নামাজের তাড়া, কাউণ্টার বন্ধ হয়ে গেছে। নামাজের পর বিল পে করে রিলিজ নিতে হবে। আমি যতই বলি রিলিজ নিয়ে রোগী চলে যাক, আমি বিল পে করার জন্য থাকি। তারা মানতে নারাজ। শেষ পর্যন্ত আমার ব্যাংকের কার্ড আর ভিজিটিং কার্ড জমা রাখলাম। তারপর রিলিজ দিল।
এই দেশে আসলে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। এর আগে হয়ত তাদের বিল না দিয়ে কেউ পালিয়ে গিয়েছিল। যদিও এরাই একবার ভুল করেছিল আর কিছু টাকা বাকি রয়ে গিয়েছিল। আমাকে ফোন করার পর আমি নিজে গিয়ে তাদের সেই বিল পরিশোধ করে এসেছিলাম।
ল্যাব এইড হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে মাত্র তিরিশ মিনিটের জন্য আমার মাকে রাখতে হয়েছিল সেখানে প্রায় সাত হাজার টাকা বিল করেছিল।
তারপরেও মন্দের ভালো রোগী নিয়ে গেলে ইমার্জেন্সিতে সেবা পাওয়া যায়। তার জন্য আপনার দরকার হবে টাকা। টাকা থাকলে এই দেশে আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
সব হাসপাতাল আর ডাক্তারই কি খারাপ?
অবশ্যই না। এই দেশে আমি এমন অনেক স্পেশালিষ্ট ডাক্তার দেখেছি যারা মাত্র ১০০ টাকার বিনিময়ে রোগী দেখেন। বিনা পয়সায় ট্রান্সপ্লান্টের মত জটিল সব অপারেশন করান। ফ্রি-তে টেস্ট করানোর ব্যবস্থা করে দেন। স্যাম্পলের ঔষধ রোগীদের দিয়ে দেন।
মিরপুরের কিডনি ফাউণ্ডেশন কিংবা শ্যামলীর সিকেডি হাসপাতালে প্রচুর রোগি হয়। এখানে নুন্যতম খরচে দেশের সেরা কিছু ডাক্তার চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে শ্যামলীর সিকেডিতে ঔষধের দামও অন্যজায়গার থেকে কম। হ্যাটস অফ টু দেম।
ঢালাওভাবে সবাইকে খারাপ কিভাবে বলি? কিন্তু ভালোরা আড়াল হয়ে যায় কর্পোরেট হাসপাতালের আড়ালে। স্বাস্থ্য সেবা একটা ব্যবসা এইখানে। স্বাধীনতার পর থেকে কোন সরকারই এই মৌলিক অধিকারকে ফ্রি করতে পারেনি। নূন্যতম সেবা পেতে হলেও আপনাকে খরচ করতে হবে অর্থ।
এর একটা কারন হতে পারে, আমাদের কোন সরকারই দেশের মানুষইকে মানুষ মনে করেনি। এখনও করে না। আপনি সরকারি মেডিকেল গুলোতে যান, সেখানে লাশ বের করতে হলেও আপনাকে স্ট্রেচারের জন্য পে করতে হবে। জীবিত মানুষ মৃত মানুষকে নিয়ে ব্যবসা করে।
একটু সামর্থ্যবান হলে তাই কেউ সরকারি হাসপাতালের বারান্দায় যেতে চায় না। মানুষ ব্যবসা করে মানুষকে নিয়ে, জীবন আর মৃত্যু নিয়ে। সৃষ্টিকর্তা হাসপাতালে না থাকলেও, তাকে ডেকে যায় অনবরত রাত জেগে থাকা রোগীর আত্মীয়স্বজন।
স্কয়ার বা এভার কেয়ারের মত ফাইভস্টার হাসপাতালে যাবার সৌভাগ্য আমার হয়নি। বেঁচে থাকতে একবার দেখার ইচ্ছা আছে। টাকা ঈশ্বরের থেকে কত বেশি শক্তিশালী সেটা নিজের চোখে দেখার খুব ইচ্ছা।